কালের সাক্ষী হয়ে আজও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের শান্তিরহাটে অবস্থিত প্রায় ৪৫০ বছরের প্রাচীন খাঁ মসজিদ। স্থানীয়দের কাছে এ মসজিদ পরিচিত গায়েবি মসজিদ ও বুজুর্গ মসজিদ নামে। ইতিহাস, জনশ্রুতি, অলৌকিক কাহিনি এবং মানুষের বিশ্বাসের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এ মসজিদ এখনো দেশ-বিদেশের মানুষের আকর্ষণ ও কৌতূহলের কেন্দ্র।
প্রবীণদের বর্ণনা অনুযায়ী, যে স্থানে এখন খাঁ মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে একসময় ছিল ঘন পাহাড়ি ঝোঁপঝাড়। খাঁ বংশের একজন ব্যক্তি নিয়মিত সেখানে গায়েবি আজানের ধ্বনি শুনতে পেতেন। পরে তিনি জায়গাটি পরিষ্কার করলে মসজিদের মতো একটি স্থাপনা দেখা যায়। এরপর খাঁ পুকুরপাড়ে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যেহেতু এটি খাঁ বংশের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাই এর নাম হয় খাঁ মসজিদ। জনশ্রুতি আছে, এই মসজিদে গভীর রাতে ও ফজরের সময় অদৃশ্য সাদা পোশাক পরিহিত মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতেন এবং গায়েবি আজান ভেসে আসত। এলাকার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে, বার আউলিয়াগণ প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে নামাজ পড়তে আসতেন। এমনকি বাঘের পিঠে চড়ে এক বুজুর্গ ব্যক্তি এ মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন বলেও শোনা যায়।
খাঁ মসজিদকে ঘিরে মানুষের বিশ্বাসও অত্যন্ত দৃঢ়। এখানে আসা অনেকেই বলেন, এ মসজিদে মানত করলে তা পূর্ণ হয়, কারও প্রার্থনা বিফলে যায় না। এজন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন। বিশেষ করে শুক্রবারে মসজিদ প্রাঙ্গণে শত শত মুসল্লির সমাবেশ ঘটে। কেউ তাদের মানতের নিদর্শন হিসেবে মসজিদের দেয়ালে চুন লেপন করেন। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষও এখানে আসেন মানত নিয়ে এবং তাদের কামনা পূর্ণ হয়েছে বলেও তারা স্বীকার করেছেন।
মসজিদটির শুরুতে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। পরে ধীরে ধীরে মাটির দেয়াল তুলে উন্নয়ন করা হয়। মসজিদের পাশেই রয়েছে কবরস্থান, যেখানে আহছান উল্লা ফকিরসহ বহু বুজুর্গ শায়িত আছেন। এজন্য অনেকে এটিকে বুজুর্গ মসজিদও বলেন। মসজিদের বর্তমান খতিব মাওলানা জরিফ আলী আরমান প্রায় ৩৯ বছর ধরে এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, খাঁ মসজিদ শুধু মুসল্লিদের নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও মানতের জায়গা। মানুষ এখানে এসে প্রার্থনা করেন এবং কামনায় সফল হন। পেশ ইমাম মাওলানা আবু জাফর আলকাদেরি জানান, প্রতিদিন শতাধিক মানুষ মসজিদে আসেন দুঃখ-কষ্টের আর্জি নিয়ে, অনেকে মানত পূর্ণ হলে কৃতজ্ঞতা জানাতে আসেন। অনেকে মসজিদের দেয়ালে চুন লেপে নিজেদের নিবেদন প্রকাশ করেন।
ইমাম আবু জাফর একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, কয়েক বছর আগে শীতের দিনে কুমিল্লা থেকে আসা এক বৃদ্ধকে তিনি মসজিদের আঙিনায় পান। বৃদ্ধ ঠান্ডায় কাঁপছিলেন এবং নামাজের সময় হয়েছে কি না জানতে চাইছিলেন। পরে তিনি নাস্তা খাইয়ে দেন। বৃদ্ধ জানান, অতীতে তিনি রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগরে কৃষিকাজ করার সময় জমির মালিকের অবিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খাঁ মসজিদে এসে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যে ব্যক্তি তার ক্ষতি করেছিলেন তিনি পঙ্গু হয়ে যান। সেই বৃদ্ধ আবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে খাঁ মসজিদে এসেছিলেন।
খাঁ মসজিদ শুধু আধ্যাত্মিকতার স্থান নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুসল্লিদের কারণে এলাকার হাটবাজার ও পরিবহন খাতে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বলয় গড়ে উঠেছে।
শত শত বছরের ইতিহাস, রহস্যময়তা, জনশ্রুতি ও মানুষের বিশ্বাস খাঁ মসজিদকে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা। এটি কেবল একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং রাঙ্গুনিয়া ও চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বল প্রতীক।