দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি)। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি দেশে-বিদেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে আসছে। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাজারো বেকার যুবক-যুবতী আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন, কেউ হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, আবার কেউবা দেশ-বিদেশের শিল্পকারখানায় স্থায়ী চাকরির সুযোগ পেয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ১৯৬২ সালে ১১ দশমিক ৩ একর জায়গার ওপর যাত্রা শুরু করে এটি, তখন নাম ছিল স্টাফ অ্যান্ড ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার (এসভিটিসি)। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে এর দায়িত্ব হস্তান্তর হয় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কাছে এবং নামকরণ করা হয় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। সময়ের সঙ্গে এর কার্যক্রম ও পরিধি বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা আইএলও, জাইকা, জেওসিভি ও ইউএনডিপি বিভিন্ন সময় উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত হয়। অবশেষে ২০০৫ সালে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কোইকা) এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে। সেই থেকেই এটি পরিচিত বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি) নামে।
শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য ছিল দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে দেশের শ্রমবাজারে এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অবদান রাখা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বর্তমানে ৪১টি ট্রেড কোর্স চালু রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে মোটরগাড়ি যন্ত্রবিদ্যা, বৈদ্যুতিক ইনস্টলেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ, রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং, টেইলারিং ও পোশাক তৈরি, ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার অপারেশনস, অটোক্যাড, কার্পেন্ট্রি, ব্লক বাটিক অ্যান্ড স্ক্রিন প্রিন্টিংসহ আরও নানা কোর্স। এগুলো নিয়মিত ছাড়াও বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ হিসেবে পরিচালিত হয়।
বিগত কয়েক বছরের সাফল্যের দিকে তাকালে বোঝা যায় বিকেটিটিসি কতটা কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। ২০২২ সালে এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন ১৭০ জন, একই বছর দেশে চাকরি পেয়েছেন ২২৪ জন এবং বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন ৬২ জন। ২০২৩ সালে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন ৩২৯ জন, দেশে চাকরি পেয়েছেন ৫৩২ জন এবং বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন ১৬৮ জন। ২০২৪ সালে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন ২৫১ জন, দেশে চাকরি পেয়েছেন ৩৬৯ জন এবং বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন ১৫২ জন। সংখ্যার এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রকৃত কারখানায় পরিণত হয়েছে।
প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য সুবিধার কথাও উল্লেখযোগ্য। এখানে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া হয় না। বরং প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে টিফিন ও যাতায়াত ভাতা দেওয়া হয়। এর ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা যুবক-যুবতীরাও সহজেই প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। তিন ও চার মাস মেয়াদী কোর্সে ভর্তির বিপরীতে প্রায়ই কয়েকগুণ বেশি আবেদন জমা পড়ে। যেমন সম্প্রতি ১১টি কোর্সে ৩৩০ জনকে ভর্তির জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়, যেখানে অংশগ্রহণ করেন এক হাজার ২০০ জন। একইভাবে চার মাসের ড্রাইভিং কোর্সে ৮০ জনকে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ৫৮০ জন।
প্রশিক্ষণের মান নিয়েও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিকেটিটিসির ইন্সট্রাক্টর মো. ইমরান চৌধুরী জানান, “আমাদের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য আশপাশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই আমাদের কাছে চাহিদাপত্র পাঠায় এবং প্রশিক্ষণ শেষে তারা সরাসরি কাজে যোগ দেন। যেহেতু তারা কাজ জানেন, তাই ভালো বেতনও পান।” একইসঙ্গে বিদেশেও বিকেটিটিসির প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সুনাম রয়েছে বলে জানান তিনি।
নারীদের অংশগ্রহণও দিন দিন বাড়ছে। ব্লক বাটিক অ্যান্ড স্ক্রিন প্রিন্টিং কোর্সের সেকশন ইনচার্জ শিখা আচার্য্য বলেন, “এই কোর্সে নারীরাই বেশি ভর্তি হয়। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক নারী এখন চাকরির পাশাপাশি নিজস্ব প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন। তারা ঘরে বসে যেমন কাজ করছেন, তেমনি সমাজে স্বাবলম্বী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।”
অধ্যক্ষ প্রকৌশলী পলাশ কুমার বড়ুয়া মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় অর্জন হলো—এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তরুণরা শুধু চাকরিই পাচ্ছেন না, বরং উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদেরও কর্মসংস্থান তৈরি করছেন। তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিকেটিটিসির প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে নিতে আগ্রহী। আমাদের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাহিদাপত্র আসে। তারা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিতে যোগ দিয়ে ভালো বেতন পাচ্ছেন।”
বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এখন চট্টগ্রামের তরুণ সমাজের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে চাকরির পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, নারীর ক্ষমতায়ন, বিনা খরচে আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান—সব মিলিয়ে বিকেটিটিসি আজ দক্ষ জনশক্তি গড়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যতেও প্রতিষ্ঠানটি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নেতৃত্ব ধরে রাখবে, এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।