রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
Single Top Banner

আলো ঝলমলে মঞ্চ থেকে পাবলিক টয়লেটের বেঞ্চে: শিল্পী মনসুর হাসানের অজানা গল্প

সাকিব উদ্দিন :

চট্টগ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যদি জামালখান মোড়ে যান, চোখে পড়বে সিটি করপোরেশনের একটি সাধারণ পাবলিক টয়লেট। সেখানেই বসে থাকেন এক মধ্যবয়সী মানুষ। চেহারায় ক্লান্তি, চোখে শূন্যতা, হাতে পুরনো মোবাইল। প্রথম দেখায় মনে হবে, তিনি হয়তো একজন সাধারণ তত্ত্বাবধায়ক, যার কাজ সারাদিন টয়লেটের দায়িত্ব দেখা।

কিন্তু অবাক হতে হয় যখন জানা যায়—এই মানুষটিই আশির দশকে চট্টগ্রামের ব্যান্ড মিউজিক জগতে তুমুল আলোড়ন তোলা শিল্পী মনসুর হাসান। যে কণ্ঠ একসময় তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে তুলত, যে গান “বাটালি হিলের সেই বিকেল” প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল—আজ সেই মানুষ মাসে মাত্র বারো হাজার টাকার বিনিময়ে পাবলিক টয়লেটের চাকরি করেন। রাত কাটে টয়লেটের সামনের একটি বেঞ্চে।

আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত চট্টগ্রামের সংগীতাঙ্গন কাঁপানো এক নাম ছিলেন মনসুর হাসান। তার লেখা, সুর করা ও গাওয়া গান তখনকার তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে তুলেছিল। “বাটালি হিলের সেই বিকেল কেন কাছে আসে না”—এই গানটি চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে ফিরত। এরপর এল “ছোট্ট একটি মেয়ে”, “সারাটি রাত”, “ফিরে এসো”, “মনটা তার চোরাবালি”, “নীল কাগজে লেখা”—যে গানগুলো তাকে এনে দিয়েছিল এক ভিন্নমাত্রার জনপ্রিয়তা।

কিন্তু সময়ের নির্মম পরিহাসে সেই গায়ক আজ আর মঞ্চে নেই, নেই আলো-ঝলমলে স্টেজ, মাইক্রোফোন কিংবা শ্রোতার উচ্ছ্বাস। বর্তমানে তাকে পাওয়া যাচ্ছে চট্টগ্রামের জামালখান মোড়ে একটি পাবলিক টয়লেটের দায়িত্বে। মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে সেই শৌচাগারের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দিন কাটান তিনি। দিন শেষে রাতে আশ্রয় মেলে টয়লেটের সামনের ছোট্ট একটি বেঞ্চে। সেখানেই তার রাত কাটে। খাবারের জন্য ভরসা পাশের হোটেল।

মাত্র ষোলো বছর বয়সেই মনসুর গানের ভুবনে প্রবেশ করেছিলেন। কলেজ জীবনে ছয় বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল ব্লু হরনেট। সেই ব্যান্ড তখন চট্টগ্রামের তরুণ সমাজের কাছে এক পরিচিত নাম। মনসুর ছিলেন ব্যান্ডের অন্যতম ভোকালিস্ট। তার লেখা ও সুর করা গানগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালে তিনি নিজের সুরে এবং এলআরবির আইয়ুব বাচ্চুর কম্পোজিশনে প্রকাশ করেন একক অ্যালবাম জুয়েল স্বরণে। ওই অ্যালবামের প্রতিটি গান মৌলিক ছিল এবং শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নেয়। সারা দেশে তখন তার নাম আলোচনায়।

মনসুর নিজেই বলেন, একসময় তিনি ৫০০’র বেশি স্টেজ শো করেছেন। প্রায়ই ঢাকার বাইরে, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও গান করার প্রস্তাব আসত। ভারত থেকেও অফার পেয়েছিলেন। তবে ব্যক্তিগত কারণে সেটি করা হয়নি। তখন মানুষ তাকে নিয়ে মুগ্ধ ছিল, আর আজ তিনি গণশৌচাগারে চাকরি করছেন। তার কথায়, “আমার বাবা-মা কেউ নেই। ভাই-বোনও নেই। সারাদিন টয়লেটেই কাটাই। রাতে বেঞ্চে ঘুমাই। এভাবেই চলছে আমার জীবন।”

এমন জীবনযুদ্ধে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন মনসুর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. পঞ্চানন আচার্যের তত্ত্বাবধানে। একসময়কার সুগঠিত কণ্ঠ আজ কষ্টে ভরা, শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ।

ব্যান্ড ভাঙনের ইতিহাসও তার জীবনে বিষাদের ছাপ ফেলেছিল। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্লু হরনেট ব্যান্ডের প্রায় ২০ লাখ টাকার বাদ্যযন্ত্র ও সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যায়। সেই ক্ষতি আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি দল। এক সময়ের সম্ভাবনাময় ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম জাহান বলেন, “মনসুর ছিল অসাধারণ প্রতিভাবান। তবে ঘূর্ণিঝড়ে সব শেষ হয়ে যায়। আমরা আবার দল গড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু মনসুরকে আর ফিরে পাইনি। পরে সে হারিয়ে যায় এক অন্ধকার জগতে।”

মনসুরের এমন করুণ পরিণতি জেনে বিস্মিত হয়েছেন সংগীতাঙ্গনের মানুষরা। জনপ্রিয় ব্যান্ড এলআরবির ইঞ্জিনিয়ার শামীম আহমেদ বলেন, “কোনো কাজকেই ছোট বলা যায় না। কিন্তু যিনি একসময় হাজারো মানুষকে মুগ্ধ করতেন, তার আজ এই পরিণতি কেন হবে? এ প্রশ্নটা শুধু মনসুরের নয়, আমাদের সবার কাছে।”

আজকের দিনে সংগীতপ্রেমীদের কাছে এই খবর দুঃখের, লজ্জার এবং মানবিক বোধে নাড়া দেওয়ার মতো। যে শিল্পী একসময় তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতেন, গানের সুরে ভরিয়ে তুলতেন শহর, আজ তিনি বেঁচে থাকার জন্য একটি গণশৌচাগারের বেঞ্চে রাত কাটান। জীবনের এমন নির্মমতা যে কোনো শ্রোতার বুক কাঁপিয়ে দেয়।

মনসুর এখনো গান ভালোবাসেন, স্মৃতি মনে করে চোখ ভিজে যায় তার। তিনি বলেন, “একসময় আমি গান লিখতাম, সুর করতাম, গাইতাম। মানুষ ভালোবাসত। এখনো অনেকেই গানগুলো মনে রেখেছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি একেবারে অন্য বাস্তবতায়।”

সংগীত ভুবনের অনেকে মনে করেন, মনসুরের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতার গল্প নয়, বরং আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অবহেলার প্রতিচ্ছবি। একজন জনপ্রিয় শিল্পীকে এভাবে বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দিয়ে সমাজ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। তাই এখনই প্রয়োজন তাকে সহযোগিতা করা—যেন শেষ বয়সটুকু অন্তত মানবিক মর্যাদায় কাটাতে পারেন।

Single Sidebar Banner
  • সর্বশেষ
  • পঠিত