চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ক্রীড়াঙ্গনের দুই লড়াকু নারী শিক্ষার্থী। একজন সাঁতারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক জয়ী হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, অন্যজন ক্যাম্পাসে একাধিকবার দ্রুততম মানবী খেতাব জিতেছেন। মাঠের সাফল্য ও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা এই দুই তারকা এখন ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের ভোটযুদ্ধে চাকসুতে লড়ছেন।
ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নুজহাত জাহান জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন “ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক” পদে। অন্যদিকে, ইংরেজি বিভাগের ১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তামান্না মাহবুব প্রীতি লড়ছেন “বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য” প্যানেল থেকে “সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক” পদটিতে। নরসিংদীর মেয়ে নুজহাত এবং নোয়াখালীর কবিরহাটের মেয়ে তামান্নার এই লড়াই চাকসু নির্বাচনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
পদকের পাহাড় নিয়ে ছাত্রী কল্যাণে নুজহাত জাহান:
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) সাবেক এই শিক্ষার্থী নুজহাতের অর্জনের তালিকা পাহাড় সম। তিনি এরমধ্যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাঁতারে ৩৫টিরও বেশি স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক জয় করেছেন। যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর উল্লেখযোগ্য সাফল্যের প্রমাণ রয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে:
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ২০১৬ সালের দক্ষিণ এশীয় জলজ চ্যাম্পিয়নশিপে ৪০০ মিটার এমআর-এ ব্রোঞ্জ পদক অর্জন। জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে ধারাবাহিকভাবে; তিনি ২৬তম, ২৭তম, ২৮তম, ২৯তম, ৩১তম ও ৩২তম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে একাধিক স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও, বিকেএসপি কাপ, জাতীয় জুনিয়র, ইন্টারমিডিয়েট ও সিনিয়র সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপসহ আরও অসংখ্য প্রতিযোগিতায় পদক জয় করেন।
চাকসু নির্বাচনে আসার কারণ জানতে চাইলে নুজহাত বলেন, আমি এই ক্যাম্পাসে বিগত চার থেকে পাঁচ বছর যাবত অধ্যায়নরত আছি এবং আমার অধ্যায়নরত অবস্থায় যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমি সেই সমস্যা গুলো সমাধান করার জন্যই এই পদটিকে বেছে নিয়েছি। যেন আমার পরবর্তী প্রজন্মে যেসব আপুরা আসবে তারা যেন সেই সকল সমস্যা গুলো সম্মুখীন না হয়।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এই পদে যদি আমি জয়ী হই, তাহলে সবাইকে একত্রে নিয়ে প্রশাসনের কাছ থেকে সকল অধিকার আদায় করে নিয়ে আসতে পারবো। এরমধ্যে যেমন, “ছাত্রীদের আবাসন, নিরাপত্তা এবং নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন। মেয়েদের পাঁচটি হল সংলগ্ন এলাকায় সুপার শপ ও ফার্মেসির ব্যবস্থা করা এবং মেডিকেল ক্যাম্পিং ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্রকে কার্যকর করা। মা শিক্ষার্থীদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার এবং নবাব ফয়জুন্নেসা হলে সুইমিং পুলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।”
নুজহাত জাহান ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রী যেন নিরাপদ, সম্মানজনক ও আত্মবিশ্বাসী পরিবেশে তার শিক্ষাজীবন কাটাতে পারে। আপনাদের আস্থা ও ভালোবাসাই হবে আমার শক্তি।”
অ্যাথলেটিক্সের অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্রীড়া সম্পাদক পদে তামান্না মাহবুব প্রীতি:
তামান্না মাহবুব প্রীতি ২০১৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত আছেন। দীর্ঘ ১১ বছরের আনুষ্ঠানিক ক্রীড়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তিনি একজন অসামান্য ক্রীড়াবিদ। বিভাগীয়, জাতীয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়—বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি তার ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৭৪টিরও বেশি বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে নিজের ব্যতিক্রমী সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।
তার উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় বার্ষিক প্রতিযোগিতা ২০২৫-এ ১০০ মিটার স্প্রিন্টে প্রথম হয়ে ‘ক্যাম্পাসের দ্রুততম মানবী’ খেতাব অর্জন। তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলে ২০২৩, ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে একাধিকবার ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কেন্দ্রীয় বার্ষিক প্রতিযোগিতাতেও তার সাফল্য চোখে পড়ার মতো; তিনি ২০২৩ ও ২০২৫ সালে ব্যক্তিগত রানার্সআপ হয়েছেন এবং ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট, চাকতি নিক্ষেপ ও ১০০ মিটার হার্ডেলসের মতো একাধিক ইভেন্টে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। এ ছাড়াও, তিনি হ্যান্ডবল টুর্নামেন্ট ও আন্তঃজেলা ভলিবল প্রতিযোগিতাতেও সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং নিয়মিতভাবে ম্যারাথন ইভেন্টে অংশগ্রহণসহ আরও অসংখ্য প্রতিযোগিতায় পদক জয় করেন।
নির্বাচনে আসার কারণ জানতে চাইলে প্রীতি বলেন, “দীর্ঘ সময় মাঠের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝেছি, আমাদের ক্যাম্পাসের খেলাধুলা কাঠামোতে কী কী সীমাবদ্ধতা রয়েছে, আবার কীভাবে একটু পরিকল্পনা, যোগ্য প্লাটফর্ম, সহযোগিতা ও উৎসাহের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের জন্য আরও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, এই পদে থেকে আমি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রীড়া-সচেতনতা বৃদ্ধি, মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারব। আমার লক্ষ্য, খেলাধুলাকে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যম না রেখে, এটি যেন শিক্ষার্থীদের ঐক্য, মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাস গঠনের অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়।”
তিনি ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা অবশ্যই বিচার বিবেচনা করে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করবেন। ‘সুস্থ দেহ, সুন্দর মন’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে আমার যাত্রা শুরু করতে চাই। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশা রাখি।”
প্রসঙ্গ, আগামী ১৫ অক্টোবর চাকসু, হলসংসদ ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ভোটের প্রচারণা শুরু হয়ে চলবে আগামী ১৪ অক্টোবর সকাল আটটা পর্যন্ত। নির্বাচনে প্রার্থী রয়েছেন ৯০৮ জন। এর মধ্যে চাকসুর ২৬টি পদের বিপরীতে ৪১৫ জন, হল সংসদে ৪৭৩ জন এবং হোস্টেল সংসদে ২০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নির্বাচনে ভোটার রয়েছেন ২৭ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১৬ হাজার ৮৪ জন ও ছাত্রী ১১ হাজার ৩২৯ জন। সবশেষ ১৯৯০ সালে নির্বাচন হয়েছে।


