চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবরশাহ থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা মো. মহিউদ্দিন মোহন (৪২) গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুর্যোগ ও ত্রাণ বিষয়ক উপ-সম্পাদক এবং দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
পুলিশের দাবি, মোহন রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার পরিকল্পনায় প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে অর্থায়ন এবং নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন।
সূত্রে জানা যায়, আকবরশাহ থানায় গত ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মোহনসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আকবরশাহ থানার অফিসার ইনচার্জসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত টহল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৩ ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টা ২৫ মিনিটের সময় একে খান মোড় এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে হাতে দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোটা ও ইট-পাটকেল নিয়ে আকবরশাহ থানাধীন কর্নেলহাট বাজার এলাকা থেকে প্রশান্তি আবাসিকের সামনের সড়কে জড়ো হয়েছে এবং সেখান থেকে একে খান মোড়ের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান পরিচালনা করে ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। তখন উপস্থিত আসামিরা পুলিশের ওপর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে এবং গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পলাতক আসামিরা দিকবেদিক পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় গ্রেপ্তার করা হয় এজাহারনামীয় ১ থেকে ৬ নম্বর আসামীকে।
গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য এবং সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা স্বীকার করে যে, পলাতক আসামীদের নির্দেশে বর্তমান সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্ত করে দেশে আনার দাবিতে মিছিল ও বিক্ষোভের আয়োজন করে। তাদের নেতৃত্বে থাকা অন্য আসামিরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৮টি কাঠের লাঠি ও ১৭টি ইটের টুকরা জব্দ করে। উপস্থিত সাক্ষীদের সামনে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে মামলার তদন্তে নতুন তথ্য উঠে আসে যে, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা মো. মহিউদ্দিন মোহন এই ঘটনাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শুধু উপস্থিতদের সংগঠিত করেননি, বরং তাদের আর্থিক সহায়তা ও প্ররোচনাও দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, মহিউদ্দিন মোহন এই ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত।
পুলিশের তদন্তে আরও উঠে আসে, মোহন অতীতে একাধিক ফৌজদারি মামলার আসামী। রাঙ্গুনিয়া থানায় তার নামে তিনটি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এছাড়াও মোহনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সাংবাদিক আবু আজাদকে হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ আছে।
স্থানীয় গ্রামবাসী জানান, মহিউদ্দিন মোহন এলাকায় এক আতংকের নাম। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মোহন এলাকায় চাঁদাবাজি, অপহরণ, টেন্ডারবাজিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যা তিনি করেনি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তার ভয়ে তটস্থ ছিল স্থানীয় লোকজন। তার কাছে বিশাল অস্ত্র ভান্ডার মজুত আছে বলে জানিয়েছে গ্রামবাসী। যদিও পুলিশ তার কাছ থেকে একটি অস্ত্রও উদ্ধার করতে পারেনি কিংবা উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করেনি।
তদন্ত কর্মকর্তা আকবর শাহ থানার এসআই মুহাম্মদ জসিম উদ্দিনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহিউদ্দিন মোহন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একাধিক সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি ও ভীতি প্রদর্শনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় এবং তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রভাব খাটিয়ে রক্ষা পেয়েছেন।
পুলিশের দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ায় তাকে ২৪ অক্টোবর রাত সাড়ে ১১টার সময় আকবরশাহ থানাধীন বাগানবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতার আসামী মো. মহিউদ্দিন মোহন রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। উক্ত মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারকার্য পরিচালনার স্বার্থে আসামীকে জেলহাজতে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন।’
বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসামির পেছনে আরও প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংগঠন জড়িত থাকতে পারে। বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।


