চট্টগ্রামের রাউজান যেন রক্ত আর আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে উঠেছে। একটার পর একটা লাশ পড়ে থাকছে রাস্তার ধারে, উঠোনে কিংবা বাড়ির সামনে। রাজনৈতিক বিরোধ আর আধিপত্যের লড়াইয়ে মানুষের জীবন যেন এখানে সবচেয়ে সস্তা। মাত্র আঠারো দিন আগে বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিমকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, এবার একইভাবে খুন হলেন যুবদল কর্মী মো. আলমগীর আলম (৪৫)।

শনিবার বিকেলে রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়ির কাছে পৌঁছানোর আগমুহূর্তে মোটরসাইকেল থামাতেই ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তলপেট, বুক ও মাথায় পাঁচটি গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। পেছনে মোটরসাইকেলে বসা এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আলমগীরের স্ত্রী ও সন্তান তখন পেছনে একটি সিএনজি অটোরিকশায় ছিলেন। তাদের চোখের সামনেই রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
রাউজানের মানুষ বলছেন, তারা এমন ভয়াবহ সময় আগে কখনও দেখেননি। দিন-রাত অজানা আতঙ্কে কাটছে। এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আলমগীর আলমের একটি ভিডিও। সেখানে দেখা যায়, তিনি এক যুবকের সঙ্গে কথা বলছেন। যুবকটি তাকে জানাচ্ছেন, কিছু লোক তার হত্যার পরিকল্পনা করেছে। উদ্বেগ নিয়ে আলমগীর বলেন, “তারা কি আমাকে বাঁচতে দেবে না? এই সপ্তাহেই মেরে ফেলবে নাকি পরে?” জবাবে যুবক বলে, “সুযোগ পেলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই মেরে ফেলবে।” কথাগুলো বলার সময় ধূমপান করতে করতে আলমগীরের মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আতঙ্ক। ভিডিওর শেষে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমি তো শুধু শান্তিতে বাঁচতে চাই। ১৭ বছর জেলে ছিলাম, এখন আর ঝামেলায় যেতে চাই না।” কিন্তু সেই শান্তির স্বপ্ন শেষ হলো বন্দুকের নল থেকে বের হওয়া গুলিতে।
রাউজানের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৭ জন খুন হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কর্মী। স্থানীয়রা বলছেন, “খুনের পর পুলিশ আসে, সুরতহাল করে, মরদেহ মর্গে পাঠায়, এরপর সব চুপ।” প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটলেও কেউ গ্রেফতার হয় না, মামলার অগ্রগতি দেখা যায় না। ফলে খুনিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “মনে হয় পুলিশের কাজ শুধু লাশ পাঠানো। ১৪ মাসে ১৭টা খুন, কিন্তু শুটাররা আজও ধরা পড়ল না। তারা এলাকায় ঘোরে, সবাই জানে, পুলিশও জানে, কিন্তু কেউ ধরছে না।”
রাউজানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক খুনের তালিকা যেন দীর্ঘ হচ্ছে। আবদুল মান্নান, ইউসুফ মিয়া, আজম খান, আবু তাহের, ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর, প্রকৌশলী নূর আলম বকুল, আবদুল্লাহ মানিক, ইব্রাহিম, সেলিম উদ্দিন— সবাই একই কায়দায় গুলি বা কুপিয়ে খুন হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাণ গেল যুবদল কর্মী আলমগীর আলমের।

এই হত্যাকাণ্ডে আলোচনায় এসেছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রায়হানের নাম। উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়াসহ নগরের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সে সক্রিয়। পুলিশের তথ্যমতে, রায়হান একসময় আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশ নিত, পরে ‘ছোট সাজ্জাদ’ নামে নগরের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠে। ভিডিওতে দেখা যায়, আলমগীরও রায়হানের নাম উল্লেখ করে এক ব্যক্তিকে বলেন, “তুমি যে শোডাউন করিয়েছ, আতঙ্ক সৃষ্টি করেছ, আমাকে তো মেরে ফেলতে পারতে। ওরা অস্ত্র নিয়ে এসেছে আমাকে ভয় দেখাতে।” কথাগুলো এখন রাউজানজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে।
পুলিশের দাবি, তারা খুনিদের ধরতে তৎপর। রাঙ্গুনিয়া–রাউজান সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, “প্রতিটি হত্যার পরই অভিযান হয়েছে, প্রায় ৭০ জন আসামি ধরা পড়েছে, অনেকেই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।” তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন— “যদি এত তৎপরতা থাকে, তাহলে খুন থামছে না কেন?”
রাউজান এখন আতঙ্কগ্রস্ত এক জনপদ। সন্ধ্যার পর মানুষ বাইরে বের হয় না। চায়ের দোকানগুলো আগেভাগেই বন্ধ হয়ে যায়। সবাই জানে, কারা এলাকায় অস্ত্র নিয়ে ঘোরে, তবু কিছুই ঘটে না। অনেকে বলছেন, পুলিশ হয় অদক্ষ, নয়তো অদৃশ্য কারও চাপে নীরব। এভাবে চলতে থাকলে রাউজান পরিণত হবে ভয় আর রক্তের শহরে— যেখানে মানুষ শুধু মরবে, বিচার পাবে না কেউ।


